আতিক আহম্মেদঃখুব কষ্টের হয় আবার আনন্দের হয়।
নড়াই জেলার একটি নাম।গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে চিত্রা নদী।
আলোকিত হয়ে উঠলো বাবা গোলাম মর্তুজার
ঘর। এক যোদ্ধার জন্ম হলো। নাম রাখা হলো
কৌশিক। চিত্রা নদীতে ঝাপ দেওয়া ছিলো
যার নিত্য দিনের কাজ। খেলাধুলার পাগল তখন
থেকেই ছিলেন । ব্যাডমিন্টনটা খেলতেন
অসাধারন আর ফুটবল তো লা-জয়াব। কিন্তু
ক্রিকেটের প্রতি ধীরে ধীরে বাড়তে লাগলো
ভালবাসা। বিশেষ করে বোলিং এর প্রতি।
পাড়ার মাঠে বোলিংএ ঝড় তুলতে লাগলেন। আর
বড় বড় ছয় মারার জন্য কৌশিকের ছিলো
অন্যরকম খ্যাতি। হয়ে গেলেন ক্রিকেট পাগলা।
অনুর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে প্রথমবারের মত জাতীয়
পর্যায়ে খেললেন। আগুনের গোলা ঝরালেন
মাঠে। চোখে পড়ে গেলেন তৎকালীন
বাংলাদেশের কোচ অ্যান্ডি রবার্টসের। ডাক
পেলেন টেস্ট খেলার জন্য। কৌশিক হয়ে উঠলেন
“মাশরাফি বিন মর্তুজা”
জীবনের প্রথম টেস্ট ক্যাপ পেলেন ২০০১ সালে
জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে। দিনটা ৮ই নভেম্বর।
বিশ্বের ৩১তম ক্রিকেটার হিসেবে কোন ১ম
শ্রেনীর ম্যাচ না খেলেই সরাসরি অভিষেক
হলো মাশরাফির। প্রতিভার কোন পর্যায়ে
থাকলে এটা সম্ভব বুঝে নিবেন সবাই। বল নিয়ে
প্রথমবারের মত দেশের পক্ষে শুরু করলেন দৌড়।
গ্যালারীতে শোর উঠলো “হইইইইইইইইইইইই”
ছুড়লেন বল। না! আহামরী কিছু হলোনা। আবারো
দৌড়ালেন। প্রথম ওভারে একের পর এক গোলা
ছুঁড়ে দিয়ে জিম্বাবুয়ের ব্যাটসম্যানদের মুখটা
করে দিলেন বাংলা “৫” এর মত। কিন্তু না
বেশীক্ষন অপেক্ষা করতে হলো না।
অসাধারণভাবে গ্রান্ট ফ্লাওয়ারকে আউট করে
বিশ্ব-ক্রিকেটকে জানিয়ে দিলেন তার
আগমনী বার্তা। সব মিলিয়ে সেই টেস্টে
নিলেন ৪ উইকেট। বৃষ্টির কারণে বল করতে
পেরেছিলেন এক ইনিংসই। এরপরেই একই
সিরিজে ওয়ানডে অভিষেক হলো মাশরাফির।
বিধ্বস্ত করতে লাগলেন আবারো জিম্বাবুয়ের
ব্যাটসম্যানদের। সবাই অবাক চাহনিতে দেখতে
লাগলো বিস্ময়বালকের বিস্ময়কর কৃতি।
কিন্তু যোদ্ধার দেশে জন্ম যে তার। যুদ্ধ করে
বাঁচাই ছিলো তার নিয়তি। বিধাতা বোধহয়
একটু মুচকিই হেসেছিলেন। ৩য় টেস্ট খেলতে
নামলেন নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে। ভালমতোই
চলছিলো। হঠাৎ পা হড়কালেন মাশরাফি। উঠার
চেষ্টা করলেন,পারলেন না। ধরাধরি করে নিয়ে
যাওয়া হলো মাঠের বাইরে। মাশরাফি কি
ভেবেছিলেন সবে যুদ্ধের শুরু?! মাঠের বাইরে
চলে গেলেন ২ বছরের জন্য।
ঐ যে বলেছি একজন যোদ্ধা তিনি। অমানুষিক,
অক্লান্ত পরিশ্রমে ২বছর পর আবার বল হাতে
দেখা গেলো মাশরাফিকে। ফিরলেন
ইংল্যান্ডের সাথে। ট্রেসকোথিক, থর্পদের
বিপক্ষে সদ্য ফেরা এক বোলার। তাচ্ছিল্যের
হাসিতেই উড়িয়ে দিতে চাইলো বোধহয়
ইংলিশরা। বিধাতা কিন্তু এবার মাশরাফির
পক্ষেই। ইংলিশ টপ-অর্ডারে কালবৈশাখী ঝড়
তুললেন “নড়াইল এক্সপ্রেস” দাম্ভিক চার
ইংলিশকে টপাটপ পকেটে পুরলেন। ৬০ রানে ৪
উইকেট নিলেন মাশরাফি। কামব্যাকের
উধাহরণসহ সংজ্ঞা বুঝিয়ে দিলেন। কিন্তু
আলাদা ধাতুর মানুষ তিনি আর ১০ জনের মত নন।
আবারো পরীক্ষায় মাশরাফি কৌশিক। ঠিক
আগের যায়গাটিতেই আবার আঘাত পেলেন। ১
বছরের জন্য মাঠের বাইরে আবার।
হারতে শিখেন নি মাশরাফি। ভেঙ্গে পড়েন নি
মাশরাফি। ইস্পাতশক্ত মনোবল আর ঠোঁট কামড়ে
ইঞ্জুরির রাশ টেনে ধরলেন। জয় করলেন ইঞ্জুরি
আবারো। ২০০৪ সালে ভারতের বিপক্ষে আবার
গোলা হাতে দেখা গেলো মাশরাফি বিন
মর্তুজাকে। শুরুতেই বাঘীয় প্রত্যাবর্তন। রাহুল
দ্রাবিড়ের মিডল স্ট্যাম্পকে ছত্রাখান করে
ফেললেন। এরপর এলো সেই দিন। ২৬শে ডিসেম্বর
২য় ওয়ানডেতে ভারতের বিপক্ষে মুখোমুখি
বাংলাদেশ। প্রথমে ব্যাট করে বাংলাদেশ
ভারতকে ছুঁড়ে দিলো ২২৪(?) রানের টার্গেট।
ব্যাটিংএ আসলো ভারত। ব্যাট দিয়ে পিচে
বাড়ি দিতে দিতে সেওয়াগ বোধহয় একটা
কুটিল হাসিই দিলো মাশরাফিকে লক্ষ্য করে।
বাঘটার ভাল লাগেনি। দৌড় শুরু করলেন নড়াইল
এক্সপ্রেস। গ্যালারীতে আবারো
“হইইইইইইইইইইইইইইই” ধ্বনি। বল করলেন মাশরাফি।
ব্যাটও চালালো সেওয়াগ। বলটা ব্যাট ফাকি
দিয়ে চলে গেলো পেছনে আর “টাক” করে একটা
শব্দ। পিছে ফিরলো সেওয়াগ। বিস্ফোরিত
দৃষ্টি নিয়ে দেখলো তিনটি স্ট্যাম্প গড়াগড়ি
খাচ্ছে মাটিতে। আবার তাকালো মাশরাফির
দিকে। বাঘটা ততক্ষনে দুই হাত প্রসারিত করে
গর্জনে ব্যস্ত। শিকার করলেন আরও একজন
ভারতীয়কে। ধরলেন বিস্ময়কর এক ম্যাচ। ম্যাচ
জিতলো বাংলাদেশ। ম্যান অফ দ্যা ম্যাচ কে?
জিজ্ঞেস করতে হয় আবার... কৌশিক হলেন
ম্যান অফ দ্যা ম্যাচ। পরের তিন বছর
বাংলাদেশের সাথে মাশরাফির সময়ও ছিলো
স্বর্ণমন্ডিত। অজি-বধ করা হলো, ৪৯ উইকেট
নিয়ে মাশরাফি হলেন ২০০৬ এর সেরা
উইকেটধারী বোলার।
এলো ২০০৭সাল। সেই অবিস্মরণীয় বিশ্বকাপের
গল্প লেখার দিন। ভারতের মুখোমুখি হবে
বাংলাদেশ। এত খুশির মাঝে তীরের মত
কৌশিকের বুকে বিঁধল বন্ধু হারানোর ব্যথা।
সড়ক দূর্ঘটনায় মারা গেলেন তার সবচেয়ে
কাছের বন্ধু মাঞ্জারুল ইসলাম রানা। শোককে
শক্তিতে পরিণত করার এক দুঃসাহস দেখালেন
মাশরাফি। অধিনায়ককে ভরসা দিলেন
“ভারতকে ধরে দিবানি”।
গায়ে ১০৩ ডিগ্রি জ্বর। কিন্তু দেশ তো আগে।
আর সাথে আছে সংকল্প। মাঠে নামলেন
কৌশিক। বল তুলে নিলেন হাতে। সেওয়াগ
নামের জল্লাদের মিডল স্ট্যাম্প উড়িয়ে দিয়ে
সুচনা করলেন ভারতবধের। একে একে ফিরালেন
উথাপ্পা, হরভজন আর মুনাফকে। ৩৮ রানে নিলেন
চার উইকেট। আবারো লাল-সবুজের জয়-জয়কার।
ভারতবধ করে বন্ধুর শোককে শক্তিতে পরিণত
করার দুঃসাহসকে জয় করলেন। এরপর সাউথ-
আফ্রিকার মুখোমুখি বাংলাদেশ। আশরাফুলের
এক অতিমানবীয় ইনিংসে বাংলাদেশ সংগ্রহ
করলো ২৫৭ রান। কিন্তু সবাই দেখি ভুলে গেলো
কৌশিকের ১৪ বলে ২৫ রানের টর্নেডোকে।
মাখায়া এন্টিনিদের আছড়ে ফেললেন মাঠের
বাইরে। আবারো উড়ল লাল-সবুজের পতাকা।
বিজয়ীর বেশে ফিরলেন দেশে।
এসেই ভারতের বিপক্ষে সিরিজ। এবার আর চমক
নয়। হোয়াইট ওয়াশ হলাম আমরা। কিন্তু বাঘটা
ঠিকই দেখিয়ে দিয়েছে। ৩য় ওয়ানডেতে রমেশ
পাওয়ারের এক ওভারে হাকালেন চারটি ছয়,
নিলেন ২৫ রান। এরপর টেস্টে আবারো
ত্রানকর্তার ভুমিকায় নড়াইল এক্সপ্রেস। না!
বোলার হিসেবে নয়, ব্যাটসম্যান মাশরাফিকে
দেখলো পুরো বিশ্ব। ১ম টেস্টের ১ম ইনিংসে ৮
উইকেট হারিয়ে তখন ফলোঅনের লজ্জায় পড়ার
ভয়ে বাংলাদেশ। শাহাদাতকে নিয়ে রেকর্ড
৭০ রানের জুটি গড়ে সেই লজ্জা ঢাকলেন
কৌশিক। শেষ টেস্টেও ব্যাট হাতে ঝড়
তুলেছিলেন যদিও শেষ রক্ষা হয়নি। ইনিংস
পরাজয়ে টেস্টের সাথে সিরিজেও হারলো
বাংলাদেশ।
এবার চলে আসি ২০০৯ সালে। ট্রাই নেশন
সিরিজে বাদ পড়ার ভয়ে বাংলাদেশ। বল হাতে
মাশরাফি কি সেটা হতে দিতে পারেন?
সাঙ্গাকারার মুখ হাঁ করে দেওয়া এক
ডেলিভারীতে মিডল স্ট্যাম্প উড়িয়ে দিলেন
কৌশিক। ঐ ম্যাচে সবচেয়ে মিতব্যয়ী বোলার
ছিলেন মাশরাফি। সাকিব জাদুতে ম্যাচ
জিতলো বাংলাদেশ। সাকিবকে কোলে তুলে
নিজের সব ক্রেডিট দিয়েই দিলেন মানুষটি।
বোনাস পয়েন্ট সহ ম্যাচ জিতে ফাইনালে
গেলো বাংলাদেশ। কিন্তু নিদারুন ব্যাটিংএ
বাংলাদেশের সংগ্রহ মাত্র ১৫৮ রান। কিন্তু ঐ
দেখা যায় গোলা হাতে কৌশিক। ভেঙ্গে
দিলেন টপ-অর্ডার। ১৬ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে
শ্রীলঙ্কা তখন ৫০এর নিচে অলআউটের ভয়ে।
ভাগ্যটা বোধহয় ছিলোনা সাথে। রুবেলের
বাজে বোলিংএ নিশ্চিত জেতা ম্যাচ হেরে
গেলো বাংলাদেশ। দল হারলে কি হবে তিনি
হারেন নি স্বভাবতই।
ঐ বছরেই ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে অধিনায়কের
দায়িত্ব পান মাশরাফি। অধিনায়ক হিসেবে
করতে আসা দ্বিতীয় ওভারেই আগের আঘাত
পাওয়া যায়গায় আবারো আঘাত পেলেন
মাশরাফি। চলে গেলেন মাঠের বাইরে। সাকিব
ম্যাচ জিতিয়ে আনার পর ঐ খোড়া পায়েই
দৌড়ে চলে গেলেন মাঠে। সেকি উল্লাস!! সেই
ট্যুর ছিলো অন্যতম সেরা একটি ট্যুর। শুধু টি-২০
ছাড়া আর সব কিছুতে ক্যারীবিয়দের হোয়াইট-
ওয়াশ করেছিলো বাংলাদেশ। এরপর প্রায় ১.৫
বছর পর আবারো দলে ফিরলেন মাশরাফি। এবং
অধিনায়ক হিসেবে। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে
১ম ম্যাচ খেলতে নামলো বাংলাদেশ। ইঞ্জুরির
নিষ্ঠুর খড়গ নেমে আসলো আবারো কৌশিকের
উপর। মাঠের বাইরে শব্দটা বোধহয় এই নিয়ে
অনেকবার ব্যবহার হলো। কি করবো ভাগ্য যে
খেলা করে তার সাথে। সেই সিরিজে
প্রথমবারের মত কিউইদের বাংলাওয়াশের
স্বাদ দিলো টাইগাররা। ইঞ্জুরিটা ছিলো
মারাত্মক। পরের বছর ঘরের মাঠে ওয়ানডে
বিশ্বকাপ। ভাগ্যের এক নিদারুণ লীলাখেলা।
মাশরাফি বাদ পড়লেন বিশ্বকাপের জন্য
ঘোষিত দল থেকে। সব ফেলে দৌড়ালেন
স্ট্যাডিয়ামে। অনেক অনুরোধের পরেও দলে
ঢুকতে পারলেন না কৌশিক। সাংবাদিকদের
সামনে বাচ্চাদের মত কেঁদেই ফেললেন
মাশরাফি। বললেন “ভাই আমি প্রয়োজনে পানি
টানবো তাও টিমে অন্তত যায়গা হোক।“ না
হলোনা। কৌশিক যায়গা পেলেন না। অভাবটা
খুবই অনুভুত হয়েছিলো বিশ্বকাপে। ছন্নছাড়া এক
পেস বাহিনী নিয়ে তাই প্রথম পর্যায়ের বাধা
টপকাতে পারলোনা বাংলাদেশ।
এত কিছুর পরও কৌশিক বারবার ফিরে আসে।
৬বার ডান পায়ে আর ৩ বার বাম পায়ে
অপারেশন করার পর কোন স্বাভাবিক মানুষের
খেলা তো দূরের কথা স্বাভাবিক চলাফেরায়
দায় হয়ে যায় সেখানে কৌশিক আজও খেলে
যায়। কোথা থেকে পান এই অনুপ্রেরণা, এই
ইস্পাতকঠিন মনোবল ? চলুন শুনে আসি তার মুখ
থেকেই “বারবার ইনজুরি থেকে ফিরে আসার
প্রেরণাও পাই সেসব বীর মুক্তিযোদ্ধার কাছ
থেকেই। এমনও ম্যাচ গেছে আমি হয়তো চোটের
কারণে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছিলাম না।
দুই-তিনটা বল করেই বুঝতে পারছিলাম সমস্যা
হচ্ছে। তখন তাঁদের স্মরণ করেছি। নিজেকে
বলেছি, ‘হাত-পায়ে গুলি লাগার পরও তাঁরা যুদ্ধ
করেছিলেন কীভাবে? তোর তো একটা মাত্র
লিগামেন্ট নেই! দৌড়া... আমরা পতাকার জন্য
খেলি, খেলি সোনার বাংলার জন্য”
২০১৪ সাল, হারের পর হারে জর্জরিত হওয়া
বাংলাদেশ ওয়ানডে দলের দায়িত্ব দেওয়া হয়
মাশরাফির কাধে। জিম্বাবুয়ে কে
হোয়াইটওয়াশের মধ্য দিয়ে শুরু হয় অধিনায়ক
ম্যাশ উপখ্যান। ওয়ার্ল্ড কাপে প্রথমবারের মত
কোয়ার্টার ফাইনাল,একে একে
পাকিস্তান,ভারত,সাউথ আফ্রিকা,জিম্বাবুয়ের
সাথে টানা সিরিজ জয় সহ ২০১৫ তে
বাংলাদেশ কোন সিরিজ ই হারে নি। এভাবেই
মাশরাফি নামক পরশ পাথরের ছোয়ায় বদলে
যায় বাংলাদেশ ক্রিকেট।
কৌশিক যখন খেলতে নামেন তখন তার হাটু
থেকে সিরিঞ্জ দিয়ে এক-প্রকারের তরল বের
করে নিতে হয়। ভয়াবহ এক যন্ত্রনায় কৌশিকের
মুখ থেকে “মাগো” চিৎকার বের হয়ে যায়
অজান্তেই। হয়তো বাংলা মাকেই স্মরণ করেন।
আর দলে মাশরাফি মানেই অন্যরকম
আত্মবিশ্বাস। সবার ভিতর থাকে জেতার তীব্র
আকাঙ্ক্ষা। থাকবেই না কেন? বড় ভাই
মাশরাফি যে ছোট ভাইদেরকে অন্য দৃষ্টিতে
দেখেন। হাসি-ঠাট্টায় মাতিয়ে রাখেন
সবাইকে। কার কোন সমস্যা সবার আগে ছুটে
যান এই মাশরাফিই। কখনো কপালে একে দেন
স্নেহের চুম্বন, কখনো স্বান্তনা। আবার কখনো
কপট রাগের ছলে বকা দেন।
আমাদের দলে আজকে বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার
সাকিব আল হাসান আছেন। কিন্তু কেউ কি
জানেন কার হাত ধরে এই সাকিবের ক্রিকেটে
আসা। বিকেএসপিতে সাকিবের ফুফাতো ভাই
উজ্জ্বল আর বাবার সাথে এসেছিলেন ফুটবল
টিমে যোগ দিতে। কিন্তু জহুরী তো রতন চিনতে
ভুল করেন না। মাশরাফি এক পলক দেখেই বুঝে
গেলেন ছেলেটা বিশ্বসেরার কাতারে যাবে।
প্রায় দেড় ঘন্টা সাকিবের বাবা আর ভাইয়ের
সাথে আলাপ করলেন। শেষ পর্যন্ত কৌশিকের
কথায় ক্রিকেট দলেই নাম লেখালেন সাকিব
আল হাসান। আর ফলাফল আজকের সাকিব।
আলাদা ধাতুতে গড়া এই মানুষটিরও কিন্তু
পারিবারিক জীবন আছে। তিনি একজন বাবা,
একজন স্বামী। মেয়ে হুমায়রা মর্তুজাকে নিয়ে
অবসর কাটিয়ে দেন কৌশিক। হুমায়রা হয়তো
এখনও জানেনা তার বাবা বাংলাদেশের
মানুষের হৃদয়ের কোন যায়গায় বসে আছেন। না
জানাই ভাল। অহঙ্কার জন্মাতে পারে। কিন্তু
অহঙ্কার কি জিনিষ তার বাবা বোধহয় জানেই
না। তাই তো ঈদের দিনে সবাই যখন দামী গাড়ী
হাকিয়ে, দামী পাঞ্জাবী গায়ে চড়িয়ে
ঈদগাহে যায় মাশরাফি তখন অন্য ১০জন মানুষের
মত হাতে জায়নামাজ নিয়ে এক কোনায় চুপটি
করে বসে নামাজ আদায় করেন। এটাই
মাশরাফি।
এই পাগলাটা বড্ড দেশের পাগল। সে জন্যই
হয়তো অনেক বড় টাকার লোভ দেখিয়েও সুবিধা
করতে পারেনি ফিক্সারের দল। উলটো সবাইকে
বলে দিয়েছিলেন বোকার মত। এই বোকা
কৌশিককেই যে আমরা খুবই ভালবাসি।
ফিক্সিং কেলেংকারীতে জর্জরিত যখন
আশরাফুল, প্রিয় বন্ধুকে ভেঙ্গে না পড়ার
উৎসাহ দিয়ে কলাম লিখেছিলেন এই
মাশরাফিই।
সবশেষে বলবো, আমাদের ছাত্রদের আর কতকাল
ফিরে আসার মন্ত্র হিসেবে রবার্ট ব্রুসের গল্প
শুনাবেন। বাবা-মাদের বলছি পিছিয়ে থাকা
ছেলে-মেয়েদের অনুপ্রেরণা হিসেবে
মাশরাফির জীবন কাহিনী শোনান। তার
বারবার ফিরে আসার কথা শোনান। আমার
দেশেই উধাহরণ থাকতে কেন বিদেশীদের
উধাহরণ টানবেন। যতদিন বাংলাদেশে ক্রিকেট
থাকবে। ততদিন উচ্চারিত হবে মাশরাফির নাম।
আমাদের ক্রিকেট ইতিহাসের সোনালী
বোর্ডটাতে সর্ব-প্রথমে জ্বলজ্বল করবে একটি
নাম। “মাশরাফি বিন মর্তুজা”।
পাগলা বুকে না মাথায় রাখবো তোমাকে যেন
পড়ে গেলে বুকে থাকো। তোমার কাছে একটাই
অনুরোধ শুধু খেলে যাও। আর কিচ্ছু চাইনা।
কৌশিকরা তো বারবার জন্মায় না। তুমি শুধু
খেলবে, মজা করবে, আর হুমায়রাকে নিয়ে সময়
কাটাবে। আর লাফটা না দিলেই কি নয়? জানি
শুনবেনা, তারপরও আমাদের মত নগন্য দর্শকদের
দিকে তাকিয়ে একটু নিরাপদে খেলো।
অসাধারণ মাশরাফিকে দেখতে যেয়ে আমরা
সাধারণ মাশরাফিকে হারাতে চাইনা।
পাগলা তোমায় সালাম।
নড়াই জেলার একটি নাম।গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে চিত্রা নদী।
সালটা ১৯৮৩,
তারিখ ৫ই অক্টোবর। এক নবজাতকের কান্নায়আলোকিত হয়ে উঠলো বাবা গোলাম মর্তুজার
ঘর। এক যোদ্ধার জন্ম হলো। নাম রাখা হলো
কৌশিক। চিত্রা নদীতে ঝাপ দেওয়া ছিলো
যার নিত্য দিনের কাজ। খেলাধুলার পাগল তখন
থেকেই ছিলেন । ব্যাডমিন্টনটা খেলতেন
অসাধারন আর ফুটবল তো লা-জয়াব। কিন্তু
ক্রিকেটের প্রতি ধীরে ধীরে বাড়তে লাগলো
ভালবাসা। বিশেষ করে বোলিং এর প্রতি।
পাড়ার মাঠে বোলিংএ ঝড় তুলতে লাগলেন। আর
বড় বড় ছয় মারার জন্য কৌশিকের ছিলো
অন্যরকম খ্যাতি। হয়ে গেলেন ক্রিকেট পাগলা।
অনুর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে প্রথমবারের মত জাতীয়
পর্যায়ে খেললেন। আগুনের গোলা ঝরালেন
মাঠে। চোখে পড়ে গেলেন তৎকালীন
বাংলাদেশের কোচ অ্যান্ডি রবার্টসের। ডাক
পেলেন টেস্ট খেলার জন্য। কৌশিক হয়ে উঠলেন
“মাশরাফি বিন মর্তুজা”
জীবনের প্রথম টেস্ট ক্যাপ পেলেন ২০০১ সালে
জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে। দিনটা ৮ই নভেম্বর।
বিশ্বের ৩১তম ক্রিকেটার হিসেবে কোন ১ম
শ্রেনীর ম্যাচ না খেলেই সরাসরি অভিষেক
হলো মাশরাফির। প্রতিভার কোন পর্যায়ে
থাকলে এটা সম্ভব বুঝে নিবেন সবাই। বল নিয়ে
প্রথমবারের মত দেশের পক্ষে শুরু করলেন দৌড়।
গ্যালারীতে শোর উঠলো “হইইইইইইইইইইইই”
ছুড়লেন বল। না! আহামরী কিছু হলোনা। আবারো
দৌড়ালেন। প্রথম ওভারে একের পর এক গোলা
ছুঁড়ে দিয়ে জিম্বাবুয়ের ব্যাটসম্যানদের মুখটা
করে দিলেন বাংলা “৫” এর মত। কিন্তু না
বেশীক্ষন অপেক্ষা করতে হলো না।
অসাধারণভাবে গ্রান্ট ফ্লাওয়ারকে আউট করে
বিশ্ব-ক্রিকেটকে জানিয়ে দিলেন তার
আগমনী বার্তা। সব মিলিয়ে সেই টেস্টে
নিলেন ৪ উইকেট। বৃষ্টির কারণে বল করতে
পেরেছিলেন এক ইনিংসই। এরপরেই একই
সিরিজে ওয়ানডে অভিষেক হলো মাশরাফির।
বিধ্বস্ত করতে লাগলেন আবারো জিম্বাবুয়ের
ব্যাটসম্যানদের। সবাই অবাক চাহনিতে দেখতে
লাগলো বিস্ময়বালকের বিস্ময়কর কৃতি।
কিন্তু যোদ্ধার দেশে জন্ম যে তার। যুদ্ধ করে
বাঁচাই ছিলো তার নিয়তি। বিধাতা বোধহয়
একটু মুচকিই হেসেছিলেন। ৩য় টেস্ট খেলতে
নামলেন নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে। ভালমতোই
চলছিলো। হঠাৎ পা হড়কালেন মাশরাফি। উঠার
চেষ্টা করলেন,পারলেন না। ধরাধরি করে নিয়ে
যাওয়া হলো মাঠের বাইরে। মাশরাফি কি
ভেবেছিলেন সবে যুদ্ধের শুরু?! মাঠের বাইরে
চলে গেলেন ২ বছরের জন্য।
ঐ যে বলেছি একজন যোদ্ধা তিনি। অমানুষিক,
অক্লান্ত পরিশ্রমে ২বছর পর আবার বল হাতে
দেখা গেলো মাশরাফিকে। ফিরলেন
ইংল্যান্ডের সাথে। ট্রেসকোথিক, থর্পদের
বিপক্ষে সদ্য ফেরা এক বোলার। তাচ্ছিল্যের
হাসিতেই উড়িয়ে দিতে চাইলো বোধহয়
ইংলিশরা। বিধাতা কিন্তু এবার মাশরাফির
পক্ষেই। ইংলিশ টপ-অর্ডারে কালবৈশাখী ঝড়
তুললেন “নড়াইল এক্সপ্রেস” দাম্ভিক চার
ইংলিশকে টপাটপ পকেটে পুরলেন। ৬০ রানে ৪
উইকেট নিলেন মাশরাফি। কামব্যাকের
উধাহরণসহ সংজ্ঞা বুঝিয়ে দিলেন। কিন্তু
আলাদা ধাতুর মানুষ তিনি আর ১০ জনের মত নন।
আবারো পরীক্ষায় মাশরাফি কৌশিক। ঠিক
আগের যায়গাটিতেই আবার আঘাত পেলেন। ১
বছরের জন্য মাঠের বাইরে আবার।
হারতে শিখেন নি মাশরাফি। ভেঙ্গে পড়েন নি
মাশরাফি। ইস্পাতশক্ত মনোবল আর ঠোঁট কামড়ে
ইঞ্জুরির রাশ টেনে ধরলেন। জয় করলেন ইঞ্জুরি
আবারো। ২০০৪ সালে ভারতের বিপক্ষে আবার
গোলা হাতে দেখা গেলো মাশরাফি বিন
মর্তুজাকে। শুরুতেই বাঘীয় প্রত্যাবর্তন। রাহুল
দ্রাবিড়ের মিডল স্ট্যাম্পকে ছত্রাখান করে
ফেললেন। এরপর এলো সেই দিন। ২৬শে ডিসেম্বর
২য় ওয়ানডেতে ভারতের বিপক্ষে মুখোমুখি
বাংলাদেশ। প্রথমে ব্যাট করে বাংলাদেশ
ভারতকে ছুঁড়ে দিলো ২২৪(?) রানের টার্গেট।
ব্যাটিংএ আসলো ভারত। ব্যাট দিয়ে পিচে
বাড়ি দিতে দিতে সেওয়াগ বোধহয় একটা
কুটিল হাসিই দিলো মাশরাফিকে লক্ষ্য করে।
বাঘটার ভাল লাগেনি। দৌড় শুরু করলেন নড়াইল
এক্সপ্রেস। গ্যালারীতে আবারো
“হইইইইইইইইইইইইইইই” ধ্বনি। বল করলেন মাশরাফি।
ব্যাটও চালালো সেওয়াগ। বলটা ব্যাট ফাকি
দিয়ে চলে গেলো পেছনে আর “টাক” করে একটা
শব্দ। পিছে ফিরলো সেওয়াগ। বিস্ফোরিত
দৃষ্টি নিয়ে দেখলো তিনটি স্ট্যাম্প গড়াগড়ি
খাচ্ছে মাটিতে। আবার তাকালো মাশরাফির
দিকে। বাঘটা ততক্ষনে দুই হাত প্রসারিত করে
গর্জনে ব্যস্ত। শিকার করলেন আরও একজন
ভারতীয়কে। ধরলেন বিস্ময়কর এক ম্যাচ। ম্যাচ
জিতলো বাংলাদেশ। ম্যান অফ দ্যা ম্যাচ কে?
জিজ্ঞেস করতে হয় আবার... কৌশিক হলেন
ম্যান অফ দ্যা ম্যাচ। পরের তিন বছর
বাংলাদেশের সাথে মাশরাফির সময়ও ছিলো
স্বর্ণমন্ডিত। অজি-বধ করা হলো, ৪৯ উইকেট
নিয়ে মাশরাফি হলেন ২০০৬ এর সেরা
উইকেটধারী বোলার।
এলো ২০০৭সাল। সেই অবিস্মরণীয় বিশ্বকাপের
গল্প লেখার দিন। ভারতের মুখোমুখি হবে
বাংলাদেশ। এত খুশির মাঝে তীরের মত
কৌশিকের বুকে বিঁধল বন্ধু হারানোর ব্যথা।
সড়ক দূর্ঘটনায় মারা গেলেন তার সবচেয়ে
কাছের বন্ধু মাঞ্জারুল ইসলাম রানা। শোককে
শক্তিতে পরিণত করার এক দুঃসাহস দেখালেন
মাশরাফি। অধিনায়ককে ভরসা দিলেন
“ভারতকে ধরে দিবানি”।
গায়ে ১০৩ ডিগ্রি জ্বর। কিন্তু দেশ তো আগে।
আর সাথে আছে সংকল্প। মাঠে নামলেন
কৌশিক। বল তুলে নিলেন হাতে। সেওয়াগ
নামের জল্লাদের মিডল স্ট্যাম্প উড়িয়ে দিয়ে
সুচনা করলেন ভারতবধের। একে একে ফিরালেন
উথাপ্পা, হরভজন আর মুনাফকে। ৩৮ রানে নিলেন
চার উইকেট। আবারো লাল-সবুজের জয়-জয়কার।
ভারতবধ করে বন্ধুর শোককে শক্তিতে পরিণত
করার দুঃসাহসকে জয় করলেন। এরপর সাউথ-
আফ্রিকার মুখোমুখি বাংলাদেশ। আশরাফুলের
এক অতিমানবীয় ইনিংসে বাংলাদেশ সংগ্রহ
করলো ২৫৭ রান। কিন্তু সবাই দেখি ভুলে গেলো
কৌশিকের ১৪ বলে ২৫ রানের টর্নেডোকে।
মাখায়া এন্টিনিদের আছড়ে ফেললেন মাঠের
বাইরে। আবারো উড়ল লাল-সবুজের পতাকা।
বিজয়ীর বেশে ফিরলেন দেশে।
এসেই ভারতের বিপক্ষে সিরিজ। এবার আর চমক
নয়। হোয়াইট ওয়াশ হলাম আমরা। কিন্তু বাঘটা
ঠিকই দেখিয়ে দিয়েছে। ৩য় ওয়ানডেতে রমেশ
পাওয়ারের এক ওভারে হাকালেন চারটি ছয়,
নিলেন ২৫ রান। এরপর টেস্টে আবারো
ত্রানকর্তার ভুমিকায় নড়াইল এক্সপ্রেস। না!
বোলার হিসেবে নয়, ব্যাটসম্যান মাশরাফিকে
দেখলো পুরো বিশ্ব। ১ম টেস্টের ১ম ইনিংসে ৮
উইকেট হারিয়ে তখন ফলোঅনের লজ্জায় পড়ার
ভয়ে বাংলাদেশ। শাহাদাতকে নিয়ে রেকর্ড
৭০ রানের জুটি গড়ে সেই লজ্জা ঢাকলেন
কৌশিক। শেষ টেস্টেও ব্যাট হাতে ঝড়
তুলেছিলেন যদিও শেষ রক্ষা হয়নি। ইনিংস
পরাজয়ে টেস্টের সাথে সিরিজেও হারলো
বাংলাদেশ।
এবার চলে আসি ২০০৯ সালে। ট্রাই নেশন
সিরিজে বাদ পড়ার ভয়ে বাংলাদেশ। বল হাতে
মাশরাফি কি সেটা হতে দিতে পারেন?
সাঙ্গাকারার মুখ হাঁ করে দেওয়া এক
ডেলিভারীতে মিডল স্ট্যাম্প উড়িয়ে দিলেন
কৌশিক। ঐ ম্যাচে সবচেয়ে মিতব্যয়ী বোলার
ছিলেন মাশরাফি। সাকিব জাদুতে ম্যাচ
জিতলো বাংলাদেশ। সাকিবকে কোলে তুলে
নিজের সব ক্রেডিট দিয়েই দিলেন মানুষটি।
বোনাস পয়েন্ট সহ ম্যাচ জিতে ফাইনালে
গেলো বাংলাদেশ। কিন্তু নিদারুন ব্যাটিংএ
বাংলাদেশের সংগ্রহ মাত্র ১৫৮ রান। কিন্তু ঐ
দেখা যায় গোলা হাতে কৌশিক। ভেঙ্গে
দিলেন টপ-অর্ডার। ১৬ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে
শ্রীলঙ্কা তখন ৫০এর নিচে অলআউটের ভয়ে।
ভাগ্যটা বোধহয় ছিলোনা সাথে। রুবেলের
বাজে বোলিংএ নিশ্চিত জেতা ম্যাচ হেরে
গেলো বাংলাদেশ। দল হারলে কি হবে তিনি
হারেন নি স্বভাবতই।
ঐ বছরেই ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে অধিনায়কের
দায়িত্ব পান মাশরাফি। অধিনায়ক হিসেবে
করতে আসা দ্বিতীয় ওভারেই আগের আঘাত
পাওয়া যায়গায় আবারো আঘাত পেলেন
মাশরাফি। চলে গেলেন মাঠের বাইরে। সাকিব
ম্যাচ জিতিয়ে আনার পর ঐ খোড়া পায়েই
দৌড়ে চলে গেলেন মাঠে। সেকি উল্লাস!! সেই
ট্যুর ছিলো অন্যতম সেরা একটি ট্যুর। শুধু টি-২০
ছাড়া আর সব কিছুতে ক্যারীবিয়দের হোয়াইট-
ওয়াশ করেছিলো বাংলাদেশ। এরপর প্রায় ১.৫
বছর পর আবারো দলে ফিরলেন মাশরাফি। এবং
অধিনায়ক হিসেবে। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে
১ম ম্যাচ খেলতে নামলো বাংলাদেশ। ইঞ্জুরির
নিষ্ঠুর খড়গ নেমে আসলো আবারো কৌশিকের
উপর। মাঠের বাইরে শব্দটা বোধহয় এই নিয়ে
অনেকবার ব্যবহার হলো। কি করবো ভাগ্য যে
খেলা করে তার সাথে। সেই সিরিজে
প্রথমবারের মত কিউইদের বাংলাওয়াশের
স্বাদ দিলো টাইগাররা। ইঞ্জুরিটা ছিলো
মারাত্মক। পরের বছর ঘরের মাঠে ওয়ানডে
বিশ্বকাপ। ভাগ্যের এক নিদারুণ লীলাখেলা।
মাশরাফি বাদ পড়লেন বিশ্বকাপের জন্য
ঘোষিত দল থেকে। সব ফেলে দৌড়ালেন
স্ট্যাডিয়ামে। অনেক অনুরোধের পরেও দলে
ঢুকতে পারলেন না কৌশিক। সাংবাদিকদের
সামনে বাচ্চাদের মত কেঁদেই ফেললেন
মাশরাফি। বললেন “ভাই আমি প্রয়োজনে পানি
টানবো তাও টিমে অন্তত যায়গা হোক।“ না
হলোনা। কৌশিক যায়গা পেলেন না। অভাবটা
খুবই অনুভুত হয়েছিলো বিশ্বকাপে। ছন্নছাড়া এক
পেস বাহিনী নিয়ে তাই প্রথম পর্যায়ের বাধা
টপকাতে পারলোনা বাংলাদেশ।
এত কিছুর পরও কৌশিক বারবার ফিরে আসে।
৬বার ডান পায়ে আর ৩ বার বাম পায়ে
অপারেশন করার পর কোন স্বাভাবিক মানুষের
খেলা তো দূরের কথা স্বাভাবিক চলাফেরায়
দায় হয়ে যায় সেখানে কৌশিক আজও খেলে
যায়। কোথা থেকে পান এই অনুপ্রেরণা, এই
ইস্পাতকঠিন মনোবল ? চলুন শুনে আসি তার মুখ
থেকেই “বারবার ইনজুরি থেকে ফিরে আসার
প্রেরণাও পাই সেসব বীর মুক্তিযোদ্ধার কাছ
থেকেই। এমনও ম্যাচ গেছে আমি হয়তো চোটের
কারণে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছিলাম না।
দুই-তিনটা বল করেই বুঝতে পারছিলাম সমস্যা
হচ্ছে। তখন তাঁদের স্মরণ করেছি। নিজেকে
বলেছি, ‘হাত-পায়ে গুলি লাগার পরও তাঁরা যুদ্ধ
করেছিলেন কীভাবে? তোর তো একটা মাত্র
লিগামেন্ট নেই! দৌড়া... আমরা পতাকার জন্য
খেলি, খেলি সোনার বাংলার জন্য”
২০১৪ সাল, হারের পর হারে জর্জরিত হওয়া
বাংলাদেশ ওয়ানডে দলের দায়িত্ব দেওয়া হয়
মাশরাফির কাধে। জিম্বাবুয়ে কে
হোয়াইটওয়াশের মধ্য দিয়ে শুরু হয় অধিনায়ক
ম্যাশ উপখ্যান। ওয়ার্ল্ড কাপে প্রথমবারের মত
কোয়ার্টার ফাইনাল,একে একে
পাকিস্তান,ভারত,সাউথ আফ্রিকা,জিম্বাবুয়ের
সাথে টানা সিরিজ জয় সহ ২০১৫ তে
বাংলাদেশ কোন সিরিজ ই হারে নি। এভাবেই
মাশরাফি নামক পরশ পাথরের ছোয়ায় বদলে
যায় বাংলাদেশ ক্রিকেট।
কৌশিক যখন খেলতে নামেন তখন তার হাটু
থেকে সিরিঞ্জ দিয়ে এক-প্রকারের তরল বের
করে নিতে হয়। ভয়াবহ এক যন্ত্রনায় কৌশিকের
মুখ থেকে “মাগো” চিৎকার বের হয়ে যায়
অজান্তেই। হয়তো বাংলা মাকেই স্মরণ করেন।
আর দলে মাশরাফি মানেই অন্যরকম
আত্মবিশ্বাস। সবার ভিতর থাকে জেতার তীব্র
আকাঙ্ক্ষা। থাকবেই না কেন? বড় ভাই
মাশরাফি যে ছোট ভাইদেরকে অন্য দৃষ্টিতে
দেখেন। হাসি-ঠাট্টায় মাতিয়ে রাখেন
সবাইকে। কার কোন সমস্যা সবার আগে ছুটে
যান এই মাশরাফিই। কখনো কপালে একে দেন
স্নেহের চুম্বন, কখনো স্বান্তনা। আবার কখনো
কপট রাগের ছলে বকা দেন।
আমাদের দলে আজকে বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার
সাকিব আল হাসান আছেন। কিন্তু কেউ কি
জানেন কার হাত ধরে এই সাকিবের ক্রিকেটে
আসা। বিকেএসপিতে সাকিবের ফুফাতো ভাই
উজ্জ্বল আর বাবার সাথে এসেছিলেন ফুটবল
টিমে যোগ দিতে। কিন্তু জহুরী তো রতন চিনতে
ভুল করেন না। মাশরাফি এক পলক দেখেই বুঝে
গেলেন ছেলেটা বিশ্বসেরার কাতারে যাবে।
প্রায় দেড় ঘন্টা সাকিবের বাবা আর ভাইয়ের
সাথে আলাপ করলেন। শেষ পর্যন্ত কৌশিকের
কথায় ক্রিকেট দলেই নাম লেখালেন সাকিব
আল হাসান। আর ফলাফল আজকের সাকিব।
আলাদা ধাতুতে গড়া এই মানুষটিরও কিন্তু
পারিবারিক জীবন আছে। তিনি একজন বাবা,
একজন স্বামী। মেয়ে হুমায়রা মর্তুজাকে নিয়ে
অবসর কাটিয়ে দেন কৌশিক। হুমায়রা হয়তো
এখনও জানেনা তার বাবা বাংলাদেশের
মানুষের হৃদয়ের কোন যায়গায় বসে আছেন। না
জানাই ভাল। অহঙ্কার জন্মাতে পারে। কিন্তু
অহঙ্কার কি জিনিষ তার বাবা বোধহয় জানেই
না। তাই তো ঈদের দিনে সবাই যখন দামী গাড়ী
হাকিয়ে, দামী পাঞ্জাবী গায়ে চড়িয়ে
ঈদগাহে যায় মাশরাফি তখন অন্য ১০জন মানুষের
মত হাতে জায়নামাজ নিয়ে এক কোনায় চুপটি
করে বসে নামাজ আদায় করেন। এটাই
মাশরাফি।
এই পাগলাটা বড্ড দেশের পাগল। সে জন্যই
হয়তো অনেক বড় টাকার লোভ দেখিয়েও সুবিধা
করতে পারেনি ফিক্সারের দল। উলটো সবাইকে
বলে দিয়েছিলেন বোকার মত। এই বোকা
কৌশিককেই যে আমরা খুবই ভালবাসি।
ফিক্সিং কেলেংকারীতে জর্জরিত যখন
আশরাফুল, প্রিয় বন্ধুকে ভেঙ্গে না পড়ার
উৎসাহ দিয়ে কলাম লিখেছিলেন এই
মাশরাফিই।
সবশেষে বলবো, আমাদের ছাত্রদের আর কতকাল
ফিরে আসার মন্ত্র হিসেবে রবার্ট ব্রুসের গল্প
শুনাবেন। বাবা-মাদের বলছি পিছিয়ে থাকা
ছেলে-মেয়েদের অনুপ্রেরণা হিসেবে
মাশরাফির জীবন কাহিনী শোনান। তার
বারবার ফিরে আসার কথা শোনান। আমার
দেশেই উধাহরণ থাকতে কেন বিদেশীদের
উধাহরণ টানবেন। যতদিন বাংলাদেশে ক্রিকেট
থাকবে। ততদিন উচ্চারিত হবে মাশরাফির নাম।
আমাদের ক্রিকেট ইতিহাসের সোনালী
বোর্ডটাতে সর্ব-প্রথমে জ্বলজ্বল করবে একটি
নাম। “মাশরাফি বিন মর্তুজা”।
পাগলা বুকে না মাথায় রাখবো তোমাকে যেন
পড়ে গেলে বুকে থাকো। তোমার কাছে একটাই
অনুরোধ শুধু খেলে যাও। আর কিচ্ছু চাইনা।
কৌশিকরা তো বারবার জন্মায় না। তুমি শুধু
খেলবে, মজা করবে, আর হুমায়রাকে নিয়ে সময়
কাটাবে। আর লাফটা না দিলেই কি নয়? জানি
শুনবেনা, তারপরও আমাদের মত নগন্য দর্শকদের
দিকে তাকিয়ে একটু নিরাপদে খেলো।
অসাধারণ মাশরাফিকে দেখতে যেয়ে আমরা
সাধারণ মাশরাফিকে হারাতে চাইনা।
পাগলা তোমায় সালাম।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন