উকিল ও বাপ। বাংলা একাডেমি ‘উকিল’ শব্দের
অর্থ লিখেছে ১. আইন ব্যবসায়ী। ২. প্রতিনিধি,
মুখপাত্র। ৩. মুসলমানদের বিয়েতে যে ব্যক্তি
কনের সম্মতি নিয়ে বরকে জানায়। (বাংলা
একাডেমি ব্যবহারিক বাংলা অভিধান,
পৃষ্ঠা-১৪৭)। আর ‘বাপ’ শব্দের অর্থ বাবা, পিতা,
জন্মদাতা ও পিতৃস্থানীয় ব্যক্তি।
ইসলামে পবিত্র বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার জন্য
দুজন পুরুষ অথবা একজন পুরুষ ও দুজন মহিলা সাক্ষী
উপস্থিত থাকা বাধ্যতামূলক। এই সাক্ষীমণ্ডলীর
একজনকে দেশীয় পরিভাষায় বলা হয় ‘উকিল
বাপ’।
আমাদের দেশে এই ‘উকিল বাপ’ ও তাঁর আত্মীয়-
স্বজনের সঙ্গে রক্তের সম্পর্কের মতো আচরণ
করা হয়।
অবলীলায় তাঁদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করা হয়।
অথচ ‘উকিল বাপ’ সংস্কৃতি ইসলামসম্মত নয়।
কেননা যদি বিয়ের সাক্ষী ব্যক্তিরাই ‘উকিল
বাপ’ হয়, তাহলে দুজন সাক্ষীই তো ‘উকিল বাপ’
হওয়ার কথা। অথচ বিয়ের সাক্ষী একজনকে
পিতার আসনে বসানো হয় আর অন্যজনকে এই
বিশেষ বিশেষণ থেকে বঞ্চিত করা হয়।
তা ছাড়া পৃথিবীতে প্রকৃত বাবা একজনই, যার
ঔরসে সন্তান জন্মগ্রহণ করেছে। এর বাইরে
ইসলাম কয়েক ধরনের ব্যক্তিকে পিতৃস্থানীয়
হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
এক. ‘দুধ পিতা’ অর্থাৎ কোনো শিশু যদি অন্য
কোনো নারীর দুধ পান করে, তাহলে সে নারীর
স্বামী উলিখিত শিশুর ‘দুধ পিতা’। এমন পিতার
সঙ্গে দুগ্ধপায়ী মেয়েশিশুর বিয়ে বৈধ নয়। তবে
তারা একে অন্যের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করতে
পারবে।
দুই. বৈবাহিক সম্পর্কের মাধ্যমে আরেক ধরনের
পিতৃত্বের সম্পর্ক সৃষ্টি হয়। দেশীয় পরিভাষায়
ওই পিতাকে বলা হয় ‘শ্বশুর’। ‘শ্বশুর’ স্বামীর
পিতা বা পিতৃস্থানীয় হওয়ার কারণে তাঁর সঙ্গে
স্থায়ীভাবে বিয়ে হারাম। স্বামী যদি কখনো
তার স্ত্রীকে তালাক দিয়ে দেয়, তাহলে
স্বামীর সঙ্গে আর দেখা করা যাবে না; কিন্তু
ওই শ্বশুর তখনো হারামই থেকে যাবেন। অর্থাৎ
তাঁর সঙ্গে বিয়ে বৈধ নয়। তাঁর সঙ্গে পিতার
মতো সর্বাবস্থায় দেখা দেওয়া যাবে।
তিন. দত্তক নেওয়া সন্তানের অভিভাবককেও
পিতার মর্যাদায় ভূষিত করা হয়। এ বিষয়ে
ইসলামের বিধান হলো, দত্তক নেওয়া সন্তানের
লালনকারীদের সম্মানার্থে মা-বাবা ডাকা
বৈধ। একইভাবে তারাও সন্তানকে স্নেহ করে
ছেলে-মেয়ে ডাকতে পারবে। তবে এটা মনে
করার সুযোগ নেই যে পালক নেওয়ায় সন্তানের
আসল মা-বাবা থেকে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেছে।
এখন লালনকারীই তার সব কিছু। এমন মনে করা
সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এটি জাহেলি যুগের কুসংস্কার।
পবিত্র কোরআনে বিষয়টি কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।
(তাফসিরে ইবনে কাসির : ৬/৩৩৭, আবু দাউদ,
হাদিস : ১৯৪০)।
লালন-পালনকারীর সঙ্গে পালিত সন্তান পর্দার
ক্ষেত্রেও পুরোপুরি ইসলামের বিধান রক্ষা করে
চলতে হবে। নিজ হাতে লালন-পালন করেছি বলে
পর্দার বিধান লঙ্ঘনের কোনো সুযোগ নেই।
অর্থাৎ পালক নেওয়া শিশুটি ছেলে হলে
প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর তাকে পালক নেওয়া
মায়ের সঙ্গে পর্দা করতে হবে। অন্যদিকে পালক
নেওয়া শিশুটি মেয়ে হলে তাকে পালক নেওয়া
বাবার সঙ্গে পর্দা রক্ষা করে চলতে হবে।
কেননা ইসলামী শরিয়ত মতে, দত্তকসংক্রান্ত
সম্পর্ক কখনো বংশীয় সম্পর্কে পরিণত হয় না।
এমনকি তাদের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্কও অন্য
সাধারণ মানুষের মতো বৈধ। (তুহফাতুল ফুকাহা :
২/১২৩)
উল্লিখিত কয়েক ধরনের পিতৃস্থানীয় ব্যক্তি
ছাড়া অন্যদের পিতা হিসেবে ইসলাম স্বীকৃতি
দেয়নি।
‘উকিল’ একটি মুসলিম পরিভাষা। বিশেষ
পদ্ধতিতে বিয়ে মুসলমানদের সংস্কৃতি।
কালক্রমে মুসলিম পরিভাষা ও সংস্কৃতির ভেতর
ইসলামবিরোধী ‘উকিল বাপ’ কালচার ঢুকে
পড়েছে। এ ‘উকিল বাপে’র সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ
বৈধ নয়। তাঁকে ‘বাবা’ ডাকারও কোনো কারণ
নেই। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি
জেনেশুনে নিজের পিতাকে ছাড়া অন্য কাউকে
পিতা বলে দাবি করে, তার জন্য জান্নাত
হারাম। ’ (বুখারি, হাদিস : ৪৩২৬) ।
উকিল বাবা সাধারণত কনের মাহরাম কোনো
আত্মীয়-স্বজন হন না; বরং তিনি গাইরে
মাহরামই হয়ে থাকেন। তাই তাঁর সঙ্গে পর্দা করা
ইসলামের দৃষ্টিতে ফরজ। শুধু সামাজিক প্রচলনের
ওপর ভিত্তি করে একজন গাইরে মাহরাম
ব্যক্তিকে ‘উকিল বাপ’ বানিয়ে তাঁর সঙ্গে
মাহরাম আত্মীয়-স্বজনদের মতো দেখা-সাক্ষাৎ
করা ইসলামের দৃষ্টিতে বৈধ নয়।
অনেক সময় দেখা যায়, মেয়ের কাছ থেকে
অনুমতি আনার সময় সাক্ষী হিসেবে উপস্থিত
থাকার জন্য উকিল বাবার সঙ্গে বর-কনে
উভয়পক্ষের দুজন সাক্ষী যায়। ইসলামের দৃষ্টিতে
গাইরে মাহরাম কেউ মেয়ের কাছে অনুমতি
আনার জন্য তার সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাৎ করতে
পারবে না। বিয়ের আগে পাত্রীকে গাইরে
মাহরামদের মধ্যে শুধু পাত্রই শর্ত সাপেক্ষে
দেখতে পারবে। সে শর্তগুলো হলো :
এক. পাত্রী দেখার সময় পাত্রের পক্ষের কোনো
পুরুষ যেমন বাপ-ভাই, বন্ধুবান্ধব প্রমুখ কেউ
থাকতে পারবে না। তাদের পাত্রী দেখা সম্পূর্ণ
নিষিদ্ধ ও কবিরা গুনাহ।
দুই . পাত্র-পাত্রী একে অন্যের সঙ্গে কথা বলতে
পারবে। কিন্তু একে অন্যকে স্পর্শ করতে পারবে
না।
তিন. পাত্রীর শুধু কবজি পর্যন্ত হাত, টাখনু
পর্যন্ত পা ও মুখমণ্ডল দেখা পাত্রের জন্য বৈধ। এ
ছাড়া শরীরের অন্য কোনো অঙ্গ আবরণ ছাড়া
দেখতে পারবে না।
চার. নির্জনে পাত্র-পাত্রী একত্রিত হওয়া বৈধ
নয়। সুতরাং যেখানে পাত্রের জন্যই এত শর্ত
রয়েছে, সেখানে ‘উকিল বাবা’ পাত্রী দেখার
তো প্রশ্নই আসে না। এমনকি পাত্রের প্রকৃত
পিতার জন্যও বিয়ের আগে তাঁর হবু পুত্রবধূকে
দেখা বৈধ নয়। (সুরা নিসা, আয়াত : ২৩,
তাফসিরে মাজহারি : ২/২৫৪)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন